প্রবাসে দেশি মানুষের আতিথেয়তা

ফিনল্যান্ডে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশোনার চাপ প্রচণ্ড রকম। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে দিয়ে ভবঘুরে হয়ে যাই। কিন্তু চাইলেই পারি না। তাই মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই। গত ফেব্রুয়ারিতে গেলাম ইতালিতে।
নির্দিষ্ট দিনে ফিনল্যান্ড (হেলসিঙ্কি) থেকে সকাল ৭টায় উড়াল দিলাম। ফিনল্যান্ডে সাধারণত শীতকালে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। সূর্যের দেখা মিলল প্রায় পাঁচ হাজার ফিট ওপরে ওঠার পর। বিমানে বিমানবালা কফি আর স্যান্ডউইচ দিয়ে গেল। ফিনল্যান্ডে শীতকালে সূর্য মামা সহজে দেখা দেয় না। তাই সূর্যের আলোটা উপভোগ করলাম বিমানের ভেতর।
সকাল ১০টায় ইতালির লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর আনাগোনা বুঝতে পারলাম যখন আমাকে কেউ একজন থামিয়ে আমার লাগেজ ট্যাগ দেখল। HEL ট্যাগ দেখে ছেড়ে দিল। যার অর্থ হলো আমি হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড) থেকে এসেছি। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বাস ধরলাম রোমের উদ্দেশে। এই সময়ে ফিনল্যান্ডে মাইনাস তাপমাত্রা আর অন্য দিকে ইতালিতে প্লাস ১৫ ডিগ্রির ওপরে হবে। বাংলাদেশের আমেজ পেলাম। ভালোই লাগল। বাসে আমি আমার গরম কাপড় খুলে ফেললাম। শুধু শার্ট। ঘামে শার্ট ভেজা শুরু হলো। রোম শহরে আসার পথে রাস্তার দুই পাশে দেখলাম ইতালিতে মানুষজনের গায়ে এখনো গরম কাপড়। আধা ঘণ্টা পর বাস থেকে নামলাম। তারপর দেখলাম রোম শহর বাংলাদেশিতে ভরপুর। প্রতি ১০ হাত অন্তর বাংলাদেশি দেখতে পাওয়া যায়। ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি থাকে যুক্তরাজ্য। তারপরের অবস্থান ইতালি।
বন্ধুর ঠিকানা দেখিয়ে একজনকে বললাম কীভাবে যাব। তিনি পথ বাতলে দিলেন। মেট্রো ধরে বন্ধুর ঠিকানায় বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম করলাম। বন্ধু গেল কাজে আর আমি ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম হাঁটতে। উদ্দেশ্য ভ্যাটিকান। 


বিকেলে বন্ধুর বাসা থেকে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটে বিশ্বের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ ভ্যাটিকান পৌঁছলাম। যার আয়তন ৪৪ হেক্টর আর জনসংখ্যা ৮৪২ জন। পোপ ফ্রান্সিস এই দেশের প্রধান। তাদের আছে নিজস্ব ডাক ব্যবস্থাও। দেখলাম পর্যটকদের বিশাল লম্বা লাইন। সবাই পোপ ফ্রান্সিসের বাসভবন বাসিলিকা দেখবে। আমি লাইন ধরলাম না। কারণ, বাসিলিকাতে প্রবেশ করতেই লাগে ঘণ্টাখানেক সময়।
ইতালিতে কয়েক দিন থেকে যা বুঝলাম তা হলো এই দেশে বাংলাদেশিসহ অনেক অবৈধ অভিবাসীর বসবাস। পুলিশ কাউকে ধরে না। কাউকে খাটো করে বলছি না বা দেখছি না। শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাই মিলে মিশে একাকার। এদের নেই কোনো ন্যূনতম আবাসন ব্যবস্থা। কাজের কথা বাদই দিলাম। তবে যারা ১৫-২০ বছর আগে এসেছে তাদের কথা ভিন্ন। বাংলাদেশে আমি অনেককেই দেখেছি ইতালিতে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করতে প্রস্তুত। কিন্তু, ইতালিতে গিয়ে কি কাজ করবে তার কোনো হিসাব বা প্রস্তুতি নাই তাদের। ইতালিতে আসার পর শুরু হয় বাস্তবতা। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হয় কোনোমতে। কাজ না থাকলে ভাড়া বাকি থাকে। কয়েক মাস ভাড়া না দিলে বাসা ছেড়ে দিতে হয়। আবার অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নেওয়া। স্থায়ী ঠিকানা না থাকলে রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া যায় না। ঝামেলা চলতেই থাকে।
বাংলাদেশিদের অনেককেই দেখলাম রাস্তাঘাটে আড্ডা মারতে। এদের অনেকেরই নেই কোনো কাজ বা অনেকেই ছোটখাট কাজ করেন বা ব্যবসা। এদের অনেকেই না পারেন নিজে চলতে না পারেন দেশে টাকা পাঠাতে। কম বেশি সবাই দেশ থেকে টাকা ধার করে ইতালিতে আসেন। তাই কষ্ট করে চললেও কেউ দেশে ফেরত যেতে চান না।
অন্যদিকে, ইতালিয়ানরা আরামপ্রিয় মানুষ। সকালের রোদে আয়েশি ভঙ্গিতে কফি পান করে। অনেককেই দেখলাম আড্ডা মারতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাদেরও অনেকেরই কাজ নাই। অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত। বর্তমানে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ।

শেষ দিন বের হলাম পকেট ক্যামেরা নিয়ে। আবার ভ্যাটিকান। বাসিলিকার ভেতরে প্রবেশের জন্য লাইন ধরলাম। ঘণ্টাখানেক পর প্রবেশ করলাম। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিসের দেখা পেলাম না। আবার লাইন ধরলাম বাসিলিকার ডোমে ওঠার জন্য। স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা শুরু করলাম। অনেকক্ষণ হাঁটলাম। 
লাইনে আমার সামনে ছিল এক মোটাসোটা জার্মান মেয়ে। 
হাঁটতে হাঁটতে হয়রান। বেচারি ডোমের কাছাকাছি গিয়ে বসে পড়ল। আরও অনেককেই দেখলাম এইরকম। এবার ডোমের পাদদেশ থেকে ডোমের ওপর ওঠার পালা। হাঁটা পথ এতই সরু যে দুই পাশের দেয়াল আমার দুই হাতের সঙ্গে লাগে এমন অবস্থা। আর ওই বেচারির কথা নাই বা বললাম। 
ডোমের একেবারে ওপরে উঠলাম। এখান থেকে সারা রোম শহর দেখা যায়। ওঠার পর সবাই উৎফুল্ল হলেও আমার চেহারা বাংলা পাঁচ হয়ে গেল। ছবি তোলার আগেই ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ। ভুলের মাশুল দিলাম। কিন্তু শেষ ভরসা মোবাইল ফোন ক্যামেরা। তারপর বন্ধুর বাসায় গিয়ে ফিনল্যান্ডে ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। 
ফিনল্যান্ডে ফেরার পালা। এই কয়েক দিন ভালোভাবেই কাটল। সুদূর ইতালিতেও চট্টগ্রামের মানুষের আতিথেয়তার প্রমাণ পেলাম আবার। বন্ধুদেরকে বিদায় দিয়ে বিকেলে রোম থেকে বাস ধরলাম। শেষ বিকেলের আলো-আঁধারির মধ্যে বাস ছুটে চলল লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমানবন্দরের উদ্দেশে।

No comments

Powered by Blogger.